বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

 

আসাদ মান্নানেরতিনি পিতা মৃত্যুহীন’’; একজন পিতৃ-পরিচয়হীন কবির অব্যক্ত কাতরতা 

                                                                                      —-----আনাছ আল জায়েদ

 



জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেনসকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি” -শুধু শব্দশৈলী দিয়ে একজন ব্যক্তি কাব্যচর্চা করতে পারলেও প্রকৃত কবি হয়ে উঠতে পারেন না । আদর্শ ও চৈতন্যবোধ  সম্পন্ন একজন শব্দ চাষীকে কেবল কবি বলতে পারি আর এক্ষেত্রে কবি আসাদ মান্নান (জ.১৯৫৭) এই দুই  পরীক্ষায় নিজেকে করেছেন উত্তীর্ণ।  ছোটবেলা থেকে  শিল্প ও  শৈল্পিকতাকে  লালন করলেওকবি হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটান  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে, তাঁর আদর্শে  অনুপ্রাণিত হয়েরাজনৈতিক দর্শনে দীক্ষিত হয়ে। তাইতো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ও মুজিববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেনতিনি পিতা মৃত্যুহীন” (২০২১) কাব্যগ্রন্থটি । এই কাব্যগ্রন্থটির মধ্যে দিয়ে একজন পিতৃ-পরিচয়হীন কবির  অব্যক্ত যন্ত্রণাকে শব্দের কথামালায় আশ্রয় ও  প্রশ্রয়  দিয়েছেন। বরাবরই  রাজনীতি সচেতন এই কবি তিনি তাঁর সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক -অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় যে অবক্ষয়ের জন্ম হয়েছে তা জাতীয়তাবাদী চেতনা সম্পন্ন কবি আসাদ মান্নানকে প্রবলভাবে পীড়িত করেছে।  

 

সত্তরের দশক থেকে কবি আসাদ মান্নান কবিতার সঙ্গে বসবাস করছেন। তাঁর সমকালীন উল্লেখযোগ্য কবিগণ হলেন কবি কামাল চৌধুরী (জ.১৯৫৭),কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৫৬ -  ১৯৯১), কবি হেলাল হাফিজ (জ.১৯৪৮)কবি ময়ূখ চৌধুরী (জ.১৯৫০)। উক্ত কবিদের হাত ধরে বাংলা কবিতার বিষয় ও শৈলীতে এসেছে বহুমাত্রিকতা, মোটা দাগে এই সময়ের কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা যে বিষয়গুলো উন্মোচন করি-

 ১.মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বপ্নময় স্বদেশভূমিকে নিয়ে প্রবল রোমান্স।

২ সমাজতন্ত্রের প্রচার ও সাম্যবাদী রাজনৈতিক উত্তাপযুক্ত কবিতা।

৩. মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে  হত্যাপরবর্তী  বিকৃত রাজনৈতিক ইতিহাসের যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের চেষ্টা । 

৪. এই দশকের কবিদের কবিতায় প্রচলিত প্রেমের নবসংজ্ঞায়ন ঘটেছে যেখানে  নগরকেন্দ্রিক দৈহিক প্রেমচর্চা ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

৫.  সর্বোপরি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯- ১৯৪৫) সাল পরবর্তী বিশ্বব্যাপী যে বিচ্ছিন্নতাবাদ,হতাশাবাদ, অস্তিত্ববাদ, জাদুবাস্তবতাবাদ চর্চিত হয় তা এই সময়ের কবিতায় ব্যাপকভাবে  প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

বাংলা কাব্যসাহিত্যে-  বিশেষত বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও জাতীয়তাবাদী ধারায় সত্তরের  দশকের উল্লেখযোগ্য আরো কবিগণ হলেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ , কবি মুহাম্মদ রফিক , কবি দাউদ হায়দার , কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা , কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ। 

 



কবি আসাদ মান্নান ১৯৫৭ সালে ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন পরবর্তী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের  একজন সচিব পদমর্যাদায় ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের বিজ্ঞসদস্য রূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন পর্যন্ত উক্ত কবির ২০টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে  যার মাঝেসূর্যাস্তের উল্টোদিকে”, “সুন্দর দক্ষিণে থাকে”, “সৈয়দ বংশের ফুল”,  “দ্বিতীয় জন্মের আগে”,”ভালবাসার আগুনের নদী”, “তোমার কীর্তন”,  “হে অন্ধ জলের রাজা” , “ হাওয়রের গান ও অন্যান্য’’, “ পিতা ও পতাকা’’  - উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে  কাব্যসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের পুরস্কারস্বরূপ অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমী পদক (২০২১)।  কবি আসাদ মান্নান তিনটি বিষয়কে বিবেচনা রেখে আজন্ম কাব্য চর্চা করেছেন একদিকে যেমন তিনি ‘Arts for art's sake বা কলাকৈবল্যবাদদর্শন থেকে শুধু শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে করেছেন শব্দের বুনন, অনুরূপ জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে এড়িয়ে যাননি ‘ Art for Man’s sake বা মানুষের জন্য শিল্পতত্ত্বকেও। প্রসঙ্গত তাঁর কাব্যে আলোচিত তিনটি বিষয় হলো-

 

১.বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

২. প্রকৃতি ও নান্দনিকতা 

৩.প্রেম ও দ্রোহ   

 

আসাদ মান্নান একটা দিব্যচেতনা থেকে নদী, নারী, সমুদ্র বা প্রকৃতিকে নিয়ে খেলায় মেতে  ওঠেন। কবিতা তখন যাবতীয় বিষয়কে স্পর্শ করে দৈবভাবে। সাধারণ নিত্যদিনের সময়সূত্রকে  অর্পণ করে অনিবার্য ও স্বতন্ত্রের প্ররোচনায়। এক্ষেত্রে কিছু আত্মমগ্নতা বা আত্মলীন অনুভবও হানা দেয় মাঝে মাঝে।’’

- নিঝুম শাহ্‌, “আসাদ মান্নানঃ একজন প্রকৃতিনিমগ্ন বিক্ষুব্ধ কবির কথা”, শব্দঘর, ঈদসংখ্যা- ২০২২,পৃষ্ঠা-১৪

 

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলা রাখাল রাজা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করাকে কেন্দ্র করে মুজিবপ্রেমী কবি আসাদ মান্নান প্রকাশ করেছেনতিনি পিতা মৃত্যুহীন” (২০২১) কাব্যগ্রন্থটিউক্ত কাব্যগ্রন্থে  স্থানলাভ করেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর লেখা ৩০টি কবিতা যাসময় প্রকাশনথেকে প্রকাশিত।  কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনপুত্র শহিদ শেখ কামাল, শহিদ শেখ জামাল, শহিদ শেখ রাসেলকে।  গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ড.  মুনতাসির মামুন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেন-

 

         “ ‘তিনি পিতা মৃত্যুহীন’- এর বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর কবিতা বুঝতে পারি। কবি কবির মতো লিখবেন কি নিজের জন্য লিখবেন নাকি অন্যদের জন্য লিখবেন? বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন নিজের জন্যকাব্যের ইতিহাসে থাকবেন। কিন্তু মানুষ পড়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, মনে রাখে অন্নদাশঙ্কর রায় বা আরো পরে শামসুর রাহমানসুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় কে। আমার এই মন্তব্য ধরা যেতে পারে নিরক্ষর এক  চাষীর যে ফসলের ক্ষেতে অভিভূত। মান্নানের এই কবিতাগুলো আমার মত সাধারণকে স্পর্শ করেছে।

-ড.  মুনতাসির মামুন

- ভূমিকা (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

 এই কাব্যগ্রন্থটি তথা সমগ্র কাব্যচর্চা সম্পর্কে কবি আসাদ মান্নান বলেন-

        “ আমার কবি জন্ম একমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্যআমার মানবজন্ম আজ ধন্য একমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্য।”      

                                   -আমার কিছু কথা 

                                  -তিনি পিতা মৃত্যুহীন(কাব্যগ্রন্থ)

 

সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠপরবর্তী এর কবিতাগুলোকে বিষয়ের দিক থেকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করতে পারি ।

 

১. বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রতি কবির সৃষ্ট রোমান্স

২. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ

৩. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের  অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ও কবির অস্তিত্বসংকট

৪. মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে শক্তির উত্থান ও বিকৃত ইতিহাসের প্রতি দ্রোহ প্রকাশ

৫. উন্নয়ন ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি জনগণের মার্কানৌকা মার্কা’-র প্রতি গভীর অনুরাগ

 

বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান  গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।ছোটবেলা থেকেই তাঁর মাঝে ছিল এক সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, যার   মাঝে ছিল নেতৃত্ব- দয়ামায়া- ভালোবাসা- স্বাধীনচেতারমত উচ্চ মন ও মানসিকতার গুণাবলী। পিতা-মাতার আদরেরখোকানামে পরিচিত ছেলেটির হাত ধরে বাঙালি জাতি পেল তাদের বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা।  বাঙালি জাতির ঝুলিতে যুক্ত হল স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র গঠনের অনন্যসম্মান ও আত্মমর্যাদাতাইতোতিনি পিতা মৃত্যুহীনকাব্যগ্রন্থটির একাধিক কবিতায় স্থান লাভ করেছে জাতির পিতার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও ভালোবাসা।

 

১.''হ্যাঁ আমি উন্মাদ নই, এবং কবিও নই- অবাধ্য প্রেমিক

 আমি ভালোবাসি নির্মেঘ নীলিমা জল পাখি 

শিশু শীত ভোরের শিশির

শোষণের প্রতিবাদে মুখরিত চিরঞ্জীব শ্রমিক জনতা,

 আমি ভালবাসি আমাদের জাতির পিতাকে 

আমি ভালোবাসি আমার জাত ও জাতীয় পতাকা।’’

          -আমি যে প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছি( তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে ছিল একদিকে শিশুরমত সারল্যঅন্যদিকে আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব। তাঁর জন্ম না হলে জন্ম হতো না বাংলাদেশের। আজন্ম লুকায়িত থাকতো বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন ও যোগ্যতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বের শুধু কবি নন, মুগ্ধ হয়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দও।

    

১.আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।

  - ফিদেল  ক্যাস্ট্রো

   - গণপ্রজাতন্ত্রী কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিংবদন্তি বিপ্লবী।

   - mujib100.gov.bd

 

২.আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব এবং কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বিশেষত্ব।

-ইয়াসির আরাফাত

- ফিলিস্তানি মুক্তি মোর্চার সাবেক নেতা ও নোবেল বিজয়ী

-mujib100.gov.bd

 

 ওই তর্জনীতে কি এমন শক্তির ইশারা ছিল-

 বিজয়ের পতাকায় দেখা গেল আকাশ ছুঁয়েছে 

সবুজে জড়িয়ে লাল বৃত্তের আগুন;অনন্তের 

তীর্থ পথে সৌরভের শিখা অম্লান  সাতই মার্চ- 

কাল থেকে কালান্তরে বাঙালির বিজয় মিনার।’’

  -মার্চের মিনার ( তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগ্রত থাকবে, এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয় সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনবদ্য অনুপ্রেরণা।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত -সুখী -সমৃদ্ধ সোনার বাংলা  যেখানে বাংলার জনগণ তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারবে,মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারবে। অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন এবং এই মুক্তিসংগ্রামে আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। কবি আসাদ মান্নান বরাবরই জাতীয়তাবাদী দর্শনকে বিবেচনা রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে হৃদয় লালন করেছেন। জাতির পিতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েতিনি পিতা মৃত্যুহীন’’ (২০২১)- কাব্যের প্রতিটি কবিতার শব্দবুনন করেছেন। .

 

১.যারা ছিল আমাদের সহোদর,বন্ধু, পিতা ও সন্তান?

 যাদের কামনা ছিল 

মানুষের স্বাধীনতা, শোষণের পূর্ণ অবসান,

 সম্পদের সুষম বণ্টন, শ্রম আর মেধার মহিমা’’

 

২.প্রতিটি গোলাপের ফিরে পাবে নিজস্ব প্রেমিক

 মানুষেরা ফিরে পাবে সম্পদের সুষম বন্টন;”

 —-আমি যে-প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছি (তিনি পিতা মৃত্যুহীন) 

 

১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর কার্যকর হওয়াগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধান”-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের মুক্তিকে।  অতীতে বহুবার বাংলার কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ শোষক শ্রেণি দ্বারা বারবার শোষিত ও নির্যাতিত হয়েছিল  উল্লেখ্য-সূর্যাস্ত আইন (১৭৯৩), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৮), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৮ - ৬০), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬- ৪৭)। শহিদের রক্তে লেখা এই সংবিধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলার এই প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের আত্মউন্নয়নকে।  বঙ্গবন্ধু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নকে বিবেচনায় রেখে সবাইকে নিয়ে একত্রে সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

 

    “ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।

—-  কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি

 - অনুচ্ছেদ (১৪)

- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধান

 জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ইতিহাস সচেতন। বাংলার মেহনতি মানুষের উপর শাসক শ্রেণির যুগ যুগ ধরে চলা বহু নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা গ্রন্থঅসমাপ্ত আত্মজীবনী”(২০১২) পাঠ করে আমরা জানতে পেরেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ(১৯৩৯-৪৫) পরবর্তী দুর্ভিক্ষ(১৯৪৩), সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা(১৯৪৬)দেশভাগ(১৯৪৭) ও নব্যসৃষ্ট পাকিস্থানে(১৯৪৭) বাংলার  মানুষের সকল সংগ্রামে স্বজন হিসেবে পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

 

আমি প্রধানমন্ত্রী তো চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই’’

  • ১৯৭১ সালে দেয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানি দর্শনে বিশ্বাসী সামরিক শাসকগোষ্ঠী ৩০ লক্ষ শহিদের ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশকে পুনরায় শ্মশানে রূপান্তর করতে চেয়েছিল তারই নির্মম দৃশ্য কবি আসাদ মান্নান তাঁরতিনি পিতা মৃত্যুহীনকাব্যেআমি যে-প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছি’’ কবিতায় তুলে ধরেছেন।

 

নেই 

সমাজ সভ্যতা দেশ দেশপ্রেম স্বাধীনতা 

আছে 

শুধু ক্ষুধা 

শুধু মহামারী 

শুধু মৃত্যু 

এবং নির্বোধ পশু অথবা পিঁপড়ের মতো 

বেঁচে থাকা।

 আমিও এমনিভাবে বেঁচে আছি ,বেঁচে আছে 

ক্ষুধার্ত স্বদেশ, তৃতীয় বিশ্বের সব কবি ও কবিতা।’’

 

- –আমি যে- প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছি (তিনি পিতা মৃত্যুহীন) 

 

১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকারীদের  দেশে-বিদেশে ভালো জায়গায় চাকুরী দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃত করেন বঙ্গবন্ধু খুনী খন্দতার মোশতাক আহমেদ ও তার সহচররা। তিনিThe Indemnity Ordinance”  (১৯৭৫) নামে কালো আইন জারি করেন এবং এর বৈধতা দেন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ।এই ঘটনা কবিহৃদয়কে করে দেয় ভেঙ্গে  চূর্ণ-বিচূর্ণ। কবি মানুষের উপর হারিয়ে ফেলেন বিশ্বাস এবং নিজেই পড়ে যান অস্তিত্বের সংকটে।

 

হ্যাঁ, আমি সেই প্রজাতন্ত্রের মানুষ 

যে-প্রজাতন্ত্রের কথা বললে 

সভ্যতা বিরোধী একটা আইন জন্ম নেবে;

 আমার হাতের দিকে এবং জিহ্বার দিকে 

হাতকরা এবং সুঁই-সূতো এগিয়ে আসবে।

  —-আমি যে-প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছি (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

স্বাধীনতাবিরোধী খুনী  মোশতাক-জিয়া শুধু জাতির পিতার হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে ক্ষান্ত হননিমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রতিনিয়ত করেছেন বিকৃত ও খাটো। জিয়াউর রহমান  নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে  ভারতের দালাল বলে  মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিলেন।এর পাশাপাশি মিথ্যা বিচারের নামে শত শত  সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিনা বিচারে ফাঁসি দেন যাদের মাঝে ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এটিএম হায়দার বীরউত্তম, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম। এই নির্মমতা কবি আসাদ মান্নানকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল এবং তিনি তাঁর শব্দকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে  এই অন্যায়ের প্রতি প্রকাশ করেছেন প্রতিবাদ ও দ্রোহ।

 সহসা আগুন লাগে যমুনার জলে 

ইতিহাস হত্যা করে মাতৃগামী ঘাতকের দল 

জন্মভূমি স্বাধীনতা 

ইতিহাস কাকে বলে- কী তার স্বরূপ

পিতা! তুমি বলো 

পাখির খাঁচার মধ্যে ঝুলে থাকা পাখির আকাশ 

আকাশের অহংকারী মেঘের মতন 

ভয়াল কুয়াশা ঘেরা স্বদেশের অন্তঃপুরে জুড়ে 

এ কেমন খোদার গজব নেমে এলো!

-সহসা আগুন লাগে যমুনার জলে (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

উল্লেখ্য, “সহসা আগুন জলে যমুনার জলেএই কবিতাটি কবি আসাদ মান্নান, জাতির পিতার হত্যার পরদিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে লিখেছিলেন। একজন শিল্পীর জায়গা থেকে, একজন তরুণের জায়গা থেকে, একজন প্রতিবাদী বিপ্লবীর জায়গা থেকে এই বিকৃত ইতিহাস তিনি চাননি গ্রহণ করতে।৩০ লাখ শহিদের রক্তে লেখা সংবিধানকে কাটছাঁট করতে এতোটুকু বিবেক বাঁধেনি পাক-দোসর জিয়াউর রহমান ও তার এদেশীয় বন্ধুদের।গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেরপ্রস্তাবনায় ধর্মীয়করণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে অদ্ভুত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তত্ত্ব চালু, সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তির স্থলে মুক্তবাজার অর্থনীতির মত উদ্ভট ধারণা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস যুক্ত করে সংবিধানকে শুধু সাম্প্রদায়িকীকরণই করেননি, পাশাপাশি একে কলঙ্কিতও করেন। এই দৃশ্য কবিরতিনি পিতা মৃত্যুহীন”(২০২১) কাব্যেরজনকের মুখসূর্যাস্তের উল্টোদিকে”  কবিতায় খুঁজে পাই।

 

রক্তে লেখা সংবিধানে আলকাতরা মেখে দেয় ওরা,

 ভুলেও চাইনি যারা স্বদেশের স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা।

-জনকের মুখ (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

আমার উত্তরে নদী, দক্ষিণের সমুদ্র আর পেছনে পাহাড় 

সম্মুখে বিশাল বধ্যভূমি;

 আর মাথার উপরে ঝুলছে

 প্রিয় জনকে রক্তে ভেজা মায়ের কফিন; আর 

আমার পায়ের নিচে, এই দেখো সূর্যাস্তের উল্টোদিকে 

রোদে জ্বলে ঘর-বাড়ি 

       ঘাসফুল

             প্রিয়তমা

                   স্বদেশ জননী আর 

                                     স্বদেশের নদী।’’

-সূর্যাস্তের উল্টোদিকে (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

ইতিহাস বিকৃতকারী জিয়াউর রহমান এদেশে যুদ্ধাপরাধী ও শান্তি কমিটির প্রধান গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।  পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধীচক্র আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে তার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশব্যাপী খুন-ধর্ষণ-লুটপাট ও সাম্প্রদায়িকীকরণের জন্ম দেয়। যুদ্ধাপরাধী আলবদর বাহিনীর সদস্য মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল কাদের মোল্লা, আব্দুল মান্নানের গাড়িতে  বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা ও তাদের মন্ত্রিত্ব  কবিকে যেমন ব্যথিত করেছে, অনুরূপ ব্যথিত করেছে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও দুলাখ মা-বোনের সম্ভ্রমকেও।

 

    “একটি শব্দ-স্বাধীনতা, প্রিয় স্বাধীনতা

  যে-মৃত্যুর চিহ্ন দিয়ে পরাজিত দস্যুর নাপাক প্রেতাত্মা

 জাহান্নামী  নির্বোধ আলবদর আজো তোর বুকে  

  আমাদের মহান আল্লাহর নামে আজান ফুকারে-

 আমার মায়ের বিধবা নিঃশ্বাস তার বুকে।

  • জন্মভূমি শুধু তোর জন্য (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

স্বাধীনতা বিরোধীরা কবি হৃদয়কে শুধু ক্ষত-বিক্ষত করেনি; বরং স্বাধীন শিল্পচর্চাকেও আঘাত করেছেন।স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও মত প্রকাশের অধিকার থেকে পুরোপুরি হয়েছেন পরাধীন। এই নিয়েআমার কিছু কথাশিরোনামে লেখায় শাসকগোষ্ঠীর চাপে হৃদয় উচ্চারিত কবিতায় প্রত্যাশিত   শব্দের প্রয়োগ থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হয়, সেই সঙ্গে মৃত্যুঘটে একজন দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকের  কাব্যসাধনার।

 

মান্নানতুমি এই কবিতাটি বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য প্রতিযোগিতার জন্য জমা দিতে পারো। তবে শিরোনাম পরিবর্তন করতে হবে এবংবিধবাশব্দটি রাখা যাবে না; এটি থাকলে আমি কবিতাটি জমা নিতে পারব না। আমি ঝামেলায় পড়বো।  তিনি কেন ঝামেলায় পড়বেন বা জমা নিতে পারবেন না সে বিষয়ে আমাদের কিছুই বলেননি। সেখানে বসেই আসাদ মান্নান কবিতার শিরোনাম ও কবিতার শেষের দিকে একটি পঙক্তি থেকে বিধবা শব্দটি বাদ দেয়। কবিতার শিরোনাম দেওয়া হয়সবুজ রমনী এক দুঃখিনী বাংলাকবিতার শরীর থেকে মুছে যায় বিধবা শব্দটি।’’

  • কবি ইউসুফ মুহম্মদ ( ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত কবিতা প্রতিযোগিতায় কবি আসাদ মান্নানের কবিতা নিয়ে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে)
  •  আমার কিছু কথা (আসাদ মান্নান)

 

১৯৭৫ সালের পরবর্তী সরকারগণ বরাবরই ইতিহাসকে বিকৃত করতে চেয়েছিলেন। ক্ষুধার্ত-দুর্যোগপীড়িত রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক সুখী দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর গড়া কল্যাণ রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে।

 সূর্যের বিরুদ্ধে গিয়ে বারবার অন্ধকার যারা ভালোবাসে 

তারা সব জন্তু-জানোয়ার 

মূলত দেশের শত্রু বিভীষণ।

জনকের মুখ(তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

তিনি পিতা মৃত্যুহীন'’(২০২১)  কাব্যগ্রন্থের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে জাতির পিতার অনুপস্থিতি ও  কবির আপনজন হারানোর মর্মবেদনা।  পিতা শুধু সন্তানকে লালনপালন করেন না , শুধু মানবিক চাহিদাই পূরণ করেন না; বরং সন্তানের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির পথও খুঁজে দেন। যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহিদ তাদের জীবন বিসর্জন করেছিল এবং ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল সেই স্বপ্ন রীতিমতো দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা কে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। হত্যা পরবর্তী অবৈধ সামরিক শাসকগণ জাতির পিতার সাথে বেইমানী করেননি বরং রাজনীতিতে ধর্মকে যুক্ত করা, দেশকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করাযুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক ,সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন করা; দেশব্যাপী জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, খুন-গুমের রাজনীতি চালু করা,  ‘হওয়া ভবনেরনামে জনগণের টাকা লুটপাট করার মাধ্যমে সোনার বাংলাকে সোনার শ্মশানে রূপান্তর করেন। অস্তিত্বহীন অভিভাবকহীন সম্পূর্ণ এতিম সন্তানের মত কবি আজ নিরাশ্রিত, পথে পথে সন্ধান করেন জনকের মুখ তাঁর চিরাচরিত হাসি তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ও আপসহীন ন্যায়বোধ।

 

১.আকাশে যেমন অই সূর্য ছাড়া আর কোনও আলোরাজ নেই 

 মাটিতে তেমন অই পিতা ছাড়া অন্যকোনও দেবতা দেখিনা।’’

  • নিঃসঙ্গ নদীর যিশু (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

২.আমাদের মহামতি পিতা আজ 

আকাশ জড়িয়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন জলে স্থলে অন্তরীক্ষে 

কে তাকে সরাতে পারে এ জাতির বুক থেকে, মন থেকে?’’

  • আমার আয়ুর বিনিময় (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

৩.শহীদের রক্ত আর মধুমতির কসম-

 জনকের রক্তমাখা চুরুটের গন্ধ ছুঁয়ে 

এবার শপথ নিচ্ছি প্রকৃত মুক্তির-

  কপোতের ডানা করে উড়াবই তোমার আঁচল;

 জাতিকে দাঁড়াতে হবে এক পায়ে মুক্তির বেদীতে।’’

  • জাতিকে দাঁড়াতে হবে (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

 বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলার আকাশে যতদিন সম্ভাবনার সূর্য থাকবে, বাংলার সংগ্রামী ইতিহাস থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান থাকবে জ্বল জ্বলে তারকা হয়ে। আজ শরীরী মুজিব উপস্থিত না থাকলেও মুজিবীয় দর্শন বাংলার প্রতিটি জাতীয়তাবাদী চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি লালন করেন- এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন কবি আসাদ মান্নান। তাইতো  কবির ভাষ্যে-

 

১.”  কে যে খুনি দুরাচার যে তোমাকে হত্যা করে?

 সে অন্ধ নির্বোধ খুনি কী করে জানবে

 এই মেঘনা পদ্মা আর যমুনার তীরে

 তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি কত উঁচু, মহিয়ান।

-যে-পিতা নিয়ত বুকে (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

২.শুধু একবার তোমাকে চুম্বন দেব-

 আর কন্ঠে তুলে নেব 

বিজয়ের কালোত্তীর্ণ জয়ধ্বনি; জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ।’’ 

  • বিজয়ের জয়ধ্বনি (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল এই ২০ বছরের পথ চলা ছিল কেবলই পিছিয়ে পড়ার গল্প, যা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান পরিপন্থী। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যাদ্বয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও দেশকন্যা শেখ রেহানা। জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত হচ্ছে তারই সোনার কন্যাদ্বয়  দ্বারা।  তাইতোতিনি পিতা মৃত্যুহীন” (২০২১) কাব্যে কবি আসাদ মান্নান জানিয়েছেন নিজের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস, বহুদিন পর ফিরে পেয়েছেন স্বপ্নের বাংলাদেশ।

 পিতা! তোমার কন্যার হাত ধরে 

আমরা ক্ষুধাও দারিদ্রকে তাড়িয়েছে;

 তার হাত ধরে 

কী অবলীলায় 

আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি 

আমরাও পারি, আমরাও 

আড়ালে যে তোমার স্বপ্নের সীমাহীন তাড়া ও তাড়না!

অভিবাদন 

দেশরত্ন শেখ হাসিনা!

 দেশ কন্যা শেখ রেহানা!

  • আমার আয়ুর বিনিময়ে ( তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

নৌকা”- কেবল একটি বাহন নয়নৌকাআমাদের ভরসার আশ্রয়, আমাদের প্রাণের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ তাঁরসোনার তরী’’-তে সোনার ফসল যেমন রেখেছিলেন, তেমনি বাংলার জেলেরা রূপলীইলিশবা সাদা সোনাচিংড়িএই নৌকায় রাখেন। সাগরে যখন প্রবল ঝড় উঠে মাঝি তখন কঠিন ও কঠোর  ঢেউ  মোকাবেলা করেন নৌকা দিয়েঅনুরূপ বাঙালি জাতির জীবনের যত সংকট- ক্রান্তি- প্রতিকূলতা এসেছে-  ‘৫৪নির্বাচন থেকে৭০ এর নির্বাচন পর্যন্ত বাংলার মানুষ আশ্রয় খুঁজেছেন নৌকায়। তাই বাঙালির এই সৌভাগ্যের প্রতীককে কবি নমস্কার জানিয়েছেন, সালাম জানিয়েছেন এবং অভিবাদন জানিয়েছেন। নৌকার মাঝি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  বাংলাদেশ থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ- জঙ্গিবাদ-সংক্রমণ ব্যাধি -সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণের জন্য আজও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।  যখন স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করেকবি তখন পরম মমতায় আশ্রয় খুঁজে নেন উন্নয়নের মার্কানৌকাপ্রতীকে।

 

নৌকায় ভোট দিলে

 তৈরি হয় 

মানুষের ইতিহাস 

নৌকায় ভোট দিলে 

শূন্য থেকে মহাশূন্যে 

তৈরি হয় 

আমাদের আশায় বসতি।’’

নৌকা মার্কায় ভোট দিলে (তিনি পিতা মৃত্যুহীন)

 

সর্বোপরি, কবির মতো আমরা যারা বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করি, সাথে পিতৃহারা বেদনাকে করি  অনুভবশত অন্ধকার আকাশে মিটমিট করে জ্বলে ওঠা তারকার কথা ভাবি তখন আমাদের নিকট নৌকা রূপে ধরা দেয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ এবং তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার  বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।  কবির মতো  পিতাহীন পরিচয়হীন মুজিবপ্রেমী জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে বসে আছেন নৌকায় এবং বৈঠা হাতে উত্তাল সাগরের সাথে একাই লড়ে যাচ্ছেন আমাদের রক্ষার্থে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জয়তু কবি আসাদ মান্নান।

                                         

 

 

 

 

 

.