শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭

দর্শন ও বিজ্ঞান


আপাতদৃষ্টিতে দর্শন ও বিজ্ঞান পরস্পর বিসদৃশ মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই নিকট ও নিবিড়। দর্শন ও বিজ্ঞানের মাঝে এই নিবিড় সম্পর্ক বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে উভয়ের স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

বিজ্ঞানের স্বরূপ

ব্যাপক অর্থে যা অজ্ঞানের অতীত তাই বিজ্ঞান। এ মতে যে বিষয়ের জ্ঞান সুনিয়ন্ত্রিত, এলোমেলো বা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নয় তাকেই বলে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান বস্তু বা ঘটনা রাশির প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে চায়। আর এই উদ্দেশ্যে সে প্রকৃতির বুকে পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে সুশৃঙ্খল, সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত জ্ঞান লাভে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টি ও ক্রমিক সত্য আবিস্কারের প্রচেষ্টা বিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল সে শুধু তত্ত্ব প্রচার করেই ঝিমিয়ে পড়ে না, মানুষের জীবন- যাত্রায়ও যে আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করে। এতেই বিজ্ঞানের সত্যিকার সার্থকতা।

দর্শন ও বিজ্ঞানের সাদৃশ্য

সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় অতীতে এমনও সময় ছিল যখন দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে আদৌ কোন সীমারেখা ছিল না। দর্শন ও বিজ্ঞান তখন একই আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। পদার্থ বিজ্ঞানের (Natural Philosophy) নামে অভিহিত করা হতো। এই কিছুদিন আগেও মনোবিজ্ঞানও দর্শনের আওতাভুক্ত ছিল। আজকের রাজনীতির বিষয় “রাষ্ট্রবিজ্ঞান” পূর্বে “রাষ্ট্রদর্শন” নামে পরিচিত ছিল।
এর কারণ হচ্ছে, দর্শন ও বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু মূলত এক ও অভিন্ন। দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়ের জীবন ও জগতের রহস্য উদঘাটন করতে চায়। জটিল বিষয়কে সহজ করা, অজানা বিষয়কে জানা, দুর্বোধ্য বিষয়কে সুবোধ্য করা উভয়ের লক্ষ্য। উভয়ের মূলে রয়েছে সত্যানুসন্ধানের অপ্রতিহত বাসনা । তাই জগত ও জীবনের ব্যাখ্যা হিসেবে দর্শন ও বিজ্ঞান একই পথের যাত্রী।

দর্শন ও বিজ্ঞানের মাঝে পার্থক্য

আলোচ্য বিষয়, লক্ষ্য ও উদ্দ্যশ্যের দিক থাকে দর্শন ও বিজ্ঞান একই পথের যাত্রী হলেও যাত্রার বাহনে, অর্থাৎ পদ্ধতি ও পরিণতির দিক থেকে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে।


এক. দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি হল অখণ্ড বা সার্বিক। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি হল খণ্ডিত বা বিশেষ। দর্শন সমগ্র বিশ্বজগৎ নিয়ে আলোচনা করে। মানবজীবনের সকলদিক দর্শন আলোচনা ক্রে।কিন্তু বিজ্ঞান বিশ্ব জগতের এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

দুই. পদ্ধতিগত দিক থেকেও দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। দর্শনের পদ্ধতি হল যৌক্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী। বিজ্ঞানের পদ্ধতি হল অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও আরোহী পদ্ধতির সাহায্যে বিজ্ঞান তাঁর আলোচ্য বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে।

তিন. দর্শন বস্তুর পরিমাণগত ও গুণগত দিক নিয়ে আলোচনা করে কিন্তু বিজ্ঞান কেবল বস্তুর পরিমাণগত দিক নিয়ে আলোচনা করে।দর্শন বস্তুর গুণগত দিক নিয়ে আলোচনা করে বলেই সে মূল্যায়নধর্মী। আর পরিমাণগত দিক নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করে বলে বিজ্ঞান বর্ণনাধর্মী।

চার. যে কোন দার্শনিক সিদ্ধান্ত সর্বজনীন ও সুনির্দিষ্ট নয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত সর্বজনীন ও সুনিশ্চিত।দার্শনিক ব্যাখ্যায় সত্যতা পরীক্ষা- নিরীক্ষা দ্ধারা যাচাই করা যায় না।

পাঁচ. বিজ্ঞান মানবমনকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। কিন্তু দর্শন সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গল এই প্রতিটি আদর্শ নিয়ে আলোচনা করে বলেই সে মানবমনকে পরিতৃপ্ত করতে পারে।


শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

মহাভারতের দুই মাতা


মহাভারত যখন লিখিতরূপ পায়(খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে)তাঁর আগে থেকে নারীর স্বাধীনতা শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে থাকে। নারীর স্বাধীনতা যুগের অনেকটা অবসান ঘটলেও থাকে তাঁর অবশেষ।এ কারণে মহাভারতের নারীদের বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে জ্বলে উঠতে দেখা যায়।

মহাভারতের প্রধান  দুইমাতা চরিত্র হল- গান্ধারী, কুন্তী  । এই দুই শক্তিশালী নারী চরিত্র মহাভারতে নতুন প্রাণ দিয়েছে। তাঁদের ত্যাগ, সাহসিকতা, স্বামীভক্তি, ব্যক্তিত্ব মহাভারতের কাহিনিকে সমৃদ্ধ করেছে।


গান্ধারী

গান্ধারী গান্ধার রাজকন্যা। পিতা গান্ধারাজ তাঁর অজ্ঞাতে হস্তিনাপুরের রাজপুরুষ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে বিয়ে দেন। গান্ধারী নির্লোভ, জ্ঞানী, দূরদর্শিনী ছিলেন। মহাভারতের কবি তাঁকে জ্ঞানবতী (সভাপর্বে)বলেছেন। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে দূরদর্শিনী (উদ্ যোগ পর্বে) এবং সার্বিক জীবনাচরণে তিনি সংযত ও সংযমী ছিলেন এ কারণে তাঁকে ‘ব্রহ্মচারিণী’(স্ত্রী পর্বে) বলা হয়েছে।

গান্ধারী পিতা এবং স্বামী উভয়ের বিরুদ্ধে তীব্র অভিমানে আহত হয়েছেন। স্বামী অন্ধ জানার পর তিনি নিজেও চোখে কাপড় বেঁধে অন্ধত্ব বরণ করেছেন। তিনি জানতেন ক্ষত্রিয় বিঁধানে স্বামীকে অতিক্রম করা যায় না।

দুর্যোধন –কর্ণ-শকুনি সাথে পুনর্বার দূতিক্রিড়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বলতা গান্ধারীর অজানা ছিল না। তাই এই সর্বনাশা ষড়যন্ত্রের শিকার না হবার জন্য তীব্র ভাষায় ধৃতরাষ্ট্রকে সর্তক করে বলেছেন,
           
                   “ মহারাজ তুমি, নিজের দোষে দুঃখের সাগরে নিমগ্ন হয়ো না। নির্বোধ অশিষ্ট পুত্রদের কথা শোন না। পাণ্ডবরা শান্ত হয়েছে, আবার কেন তাঁদের ক্রুদ্ধ করছ? তুমি স্নেহাবশে দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে পারনি, এখন তাঁর ফলে সর্বনাশ হবে’’।
                               (সভাপর্ব)

দুর্যোধন কর্তৃক কৃষ্ণের সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে, গান্ধারী দুর্যোধনকে তিরস্কার করে বলেন,
                
                 ‘পুত্র আমার পিতা ও ভীষ্ম দ্রোনাদি সুহ্রদগণের কথা রাখ। রাজত্বের অর্থ মহৎ প্রভুত্ব তা কোন দুরাত্মারা এই পদ কামনা করতে পারে না। পাণ্ডবগণ ঐক্যবদ্ধ মহাবীর, তাঁদের সাথে মিলিত হলে তুমি সুখে পৃথিবী ভোগ করতে পারবে।বৎস, ভীষ্ম দ্রোণ যা বলেছেন তা সত্য, কৃষ্ণার্জুন অজেয়’।
                                      (উদ্ যোগ পর্ব)

মহাভারতের কাহিনিতে প্রথম থেকে গান্ধারী সত্য, ন্যায় আর কল্যাণের পথে ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকালে, দুর্যোধন প্রতিদিন মায়ের কাছে আশীর্বাদ চেয়েছেন আর তাঁর উত্তরে মা গান্ধারী বলেছেন,

               ‘যে পক্ষে ধর্ম সেই পক্ষেই জয় হবে’।
                                           (স্ত্রী পর্ব)

জ্ঞানী গান্ধারী জানতেন দুই কুলের মধ্যমণি কৃষ্ণ এই ভয়াবহ যুদ্ধ থামাতে পারতেন কিন্তু থামান নি। তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেছেন,
    
              “ মধুসূদন তুমি কেন এই যুদ্ধ হতে দিলে?তুমি যখন কুরুপাণ্ডব জ্ঞাতিদের বিনাশ অপেক্ষা করছো, তখন তোমার জ্ঞাতিগণকেও তুমি বিনষ্ট করবে’’।
                          (স্ত্রী পর্ব)


কুন্তী


জন্মের আগেই কুন্তীর ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর পিতার নাম শূরসেন এবং স্বামীর নাম পান্ডু। অঙ্গরাজ কর্ণ, ইন্দ্রপ্রস্থের অধিপতি যুধিষ্ঠির, ভীম এবং অর্জুন তাঁর পুত্র। যমজ সহদর নকুল ও সহদেব তাঁর সতীন মাদ্রীর গর্ভে জন্মালেও কুন্তী তাঁদের নিজ সন্তানদের মত ভালোবাসতেন।

কুন্তী যখন কুমারী ছিলেন তখন তাঁর গৃহে দুর্বাসামুনি অতিথি হয়ে আসে এবং কুন্তী তাঁকে সেবা দ্বারা সন্তুষ্ট করেন। এতে খুশি হয়ে দুর্বাসামুনি তাঁকে এক অদ্ভুত বর দেন। বর পেয়ে কৌতূহলী কুন্তী কুমারী অবস্থায় সূর্যদেবকে কামনা করে বসেন এবং সূর্যদেবের সাথে মিলিত হয়ে এক পুত্র জন্ম দেন যাকে পরবর্তীতে যমুনার জলেতে ভাসিয়ে দেন। এই পুত্র পরবর্তীতে কর্ণ নামে পরিচিত হন।

পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর পর কুন্তী নিজের ও মাদ্রীর ছেলেদের নিয়ে হস্তিনাপুরে আসেন।নিজ পুত্র ও মাদ্রী পুত্রের মাঝে কোন ভেদ করেননি। সমান আন্তরিকতায় সবাইকে ভালোবেসেছেন। মায়ের এই গুন পরবর্তীতে যুধিষ্ঠিরকে পেয়েছিল। বন পর্বে, যজ্ঞ তাঁকে মৃত ভাইদের মাঝে যেকোন একজনকে জীবনদান করতে চাইলে যুধিষ্ঠির নকুলের জীবন প্রার্থনা করেন।
  
                ‘ কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই আমার পিতার স্ত্রী, এদের দুজন পুত্র জীবিত থাকুক এই আমার ইচ্ছা, মাতা কুন্তীর পুত্র হিসেবে আমি জীবিত আছি আর মাতা মাদ্রীর একজন পুত্র জীবিত থাকুক এই আমার ইচ্ছা। আমি দুই মাতাকেই তুল্যজ্ঞান করি’।
                                         (বন পর্ব)


যুধিষ্ঠির রাজ্যগ্রহণের পর কুন্তী তাঁকে উপদেশ দেয়,
            
     ‘যুধিষ্ঠির তুমি কখনও সহদেবের উপর অপ্রসন্ন হয়ো না, সে তোমার ও আমার অনুরক্ত। কর্ণকে সর্বদা স্মরণ করে, সর্বদা সকলে দ্রৌপদীর প্রিয় সাধন করবে। কুরুকুলের ভার তোমার উপরই পড়েছে’।

সার্বিক ভাবে, মাতৃস্নেহের দুই প্রতিচ্ছবি মাতা গান্ধারী ও মাতা কুন্তী মানবীয় আচরণ হাজার বছর ধরে বয়ে চলেছে ভারতীয় নারীরা। ব্যক্তিগত দোষ ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু মাতৃস্নেহে সবাই এক।







                               

বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

ভারতীয় দর্শন


প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞান প্রভাবিত যুগ পর্যন্ত ভারতবর্ষের ঋষি -মুনি যোগী- সন্ন্যাসী জীবন জগতের মৌলিক প্রশ্নাবলী নিয়ে যে চিন্তা ভাবনা করেছেন তাঁদের সমন্বিত রূপকে বলা হয় ভারতীয় দর্শন

সভ্যতার সেই ঊষালগ্ন থেকেই ভারতীয় মনীষীরা জগতের স্বরূপ কি? জগতের মাঝে মানুষের অধিষ্ঠান কি রূপ, ভালো-মন্দের মাপকাঠি কীসে, বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়, মানুষের আদিবাস কোথায় তাঁর স্বরূপ কি, সে-জগতের সাথে জগতের সম্পর্ক কি, স্রষ্টা বলে যাকে আমরা স্বীকার করি তাঁর স্বরূপ কি?জীবনের লক্ষ্য কি? মানুষের চারদিকে এত দুঃখ- দুর্দশা কেন?কীভাবে মানুষ এই চক্রায়িত দুষ্ট বলয় থেকে মুক্তি পেতে পারে? ধর্ম- অর্থ- কাম- মৌক্ষ এই চারটি জীবনাদর্শের মাঝে কোনটি মানুষের জন্য সর্বোত্তম কাম্য- জাতীয় মৌলিক প্রশ্নের যথার্থ অনুসন্ধান করে ভারতীয় দর্শন
 বেদকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দর্শনের উৎপত্তি ঘটেছে বলে মনে করে আধুনিক পণ্ডিতরা আধুনিক বিদ্বানদের মতে, বেদ হচ্ছে ভারতের প্রাচীন সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তাধারা দর্শনের একমাত্র ধারক বাহক
আধুনিক বিদ্বানদের মতে, ভারতীয় দর্শনের বিবর্তনের ইতিহাস এক অনন্য বিশিষ্টয়ের অধিকারী। ভারতীয় দার্শনিকরা দর্শনকে কেবল তত্ত্বালোচনার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেন নি বরং তাঁদের কাছে দর্শন হল জীবনকে যথার্থভাবে পরিচালিত করা।

একজন ভারতীয় দার্শনিক প্রথমে প্রতিপক্ষের বক্তব্য শ্রদ্ধার সাথে শ্রবণ করেন, তারপর প্রতি পক্ষের বক্তব্য খণ্ডন করেন এবং সবশেষে নিজের বক্তব্য হাজির করেন।

ভারতীয় দর্শন বিকাশের শ্রেণিবিভাগের সময়।
১. খ্রিষ্টপূর্ব     ১৬০০- ১৫০০ = বৈদিক যুগ
২. খ্রিষ্টপূর্ব      ৬০০-২০০ =  মহাকব্যের যুগ
৩. খ্রিষ্টপূর্ব   ২০০ থেকে শুরু = সূত্র- সাহিত্যের যুগ
৪. খ্রিষ্টপূর্ব   ২০০ থেকে শুরু = পাণ্ডিত্যের যুগ।


ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

কোন বিশেষ দেশের দার্শনিক চিন্তার  বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আমরা সে দেশের ভৌগলিক অবস্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারি। ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আমরা ভারতবর্ষের সাম্যক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারি।

ভারতবর্ষ প্রধানত একটি কৃষি প্রধান দেশ। ভারতবর্ষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই সৌন্দর্যই সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি স্বদেশি ও বিদেশি পর্যটক ও পরিব্রাজকদের কাব্যিক ও দার্শনিক দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে।

এক- সম্প্রদায় নির্ভরতা

যে সকল সম্প্রদায়ের উদ্ভব ভারত বর্ষে ঘটেছে তারাই পরবর্তীতে বিকশিত হয়েছে। কোন দার্শনিক ব্যক্তি- সত্বার দাবি করেননি। প্রত্যেকই কোন না কোন সম্প্রদায়ের সমর্থক। তাই নতুন কথাগুলোও তাঁরা পুরাতনের মত সমর্থন করে গেছেন। তাই ভারতীয় দর্শন একান্তভাবে সম্প্রদায় নির্ভর।

দুই- অতীতনির্ভর

ভারতীয় দর্শন অতীতকে বাদ দিয়ে সামনের দিকে এগুতে পারেনি। একারণেই ভারতীয় দর্শনের আধুনিক ব্যাখ্যায়ও প্রাচীন, এমনকি সভ্যতার আদিপর্বের বহু ধ্যান ,ধারনা ও সংস্কারের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। অতীত নির্ভর বলেই ভারতীয় দার্শনিকের তথাকথিত অভিনব তত্ত্বে উপনীত হওয়ার পরিবর্তে প্রাচীন তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যেই নিজেদের মতবাদকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।

তিন- সূত্র নির্ভরতা

ভারতীয় দর্শনের অপর একটি বৈশিষ্ট্যের মাঝে সূত্র সাহিত্যের উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়া। ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত ইতিহাসে এই পর্যন্ত যে সকল সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাঁদের সবার মূলগ্রন্থেই এক একটি সূত্র সংকলনের অস্তিত্ব দেখা যায়।

চার- রচনা শৈলীর বিশিষ্টতা

রচনা শৈলীর স্বকীয়তা ভারতীয় দর্শনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানকার দার্শনিকদের রচনারীতি তিনটি ক্রমে বিন্যস্ত। যথা. পূর্বপক্ষ, নিরাকরণ ও সিদ্ধান্ত। এখানে প্রথমে প্রতিপক্ষের মতকে শ্রদ্ধার সাথে শ্রবণ করা হয়, যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের মতের নিরাকরণ করা হয় এবং সবশেষে নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়।

পাঁচ- ধর্মের সাথে দর্শনের সংযোগ

ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম ও দর্শনের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় অধিকাংশ সম্প্রদায়ই ধর্ম আর দর্শন এক চোখে দেখেছে। ভারতীয় দার্শনিকরা ধর্ম আর দর্শনকে জীবনের সাথে সংযোগ করেছেন।

ছয়- কর্মবাদ

ভারতীয় দর্শনে দুঃখবাদের মূলভিত্তি কর্মবাদ। মানুষের ভাগ্য তাঁর কর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষের শুভ- অশুভ, পূর্ণ- অপূর্ণ তাঁর ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।



                                                              



শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭

বাক্যের দ্ব্যর্থকতা

দ্ব্যর্থকতা হল ভাষার বাগর্থিক ত্রুটি বিশেষ। যুক্তির মধ্যদিয়ে একটি বাক্যকে যদি একাধিক অর্থে ব্যবহার করা যায় অথবা বাক্যটি এরূপ ভাবে গঠিত হয় যার একাধিক অর্থ করা সম্ভব তাকে বাক্যের দ্ব্যর্থকতা বলে।
সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য এরূপ বাক্য পরিহার করা উচিত। প্রাচীন গ্রিসের দেবমন্দিরের রক্ষকরা এরকম দ্ব্যর্থক বাক্য ব্যবহার করে ভবিষ্যৎবাণী দিতেন। প্রাচীন লিডিয়ার সম্রাট ক্রিসাস পারস্য রাজ্য ধ্বংস করার পূর্বে দেবতার কাছে ভবিষ্যৎ জানতে চায়। দেবতারা বলেন যে,
   ‘ আপনি একটি বিরাট সাম্রাজ্য ধ্বংস করবেন’- পরে দেখা গেল, পারস্য রাজ্য নয় নিজ রাষ্ট্র
বাক্যের দ্ব্যর্থকতা ২ ধরনের হতে পারে। যথা.
১. শব্দজাত দ্ব্যর্থকতা।
২. গঠনজাত দ্ব্যর্থকতা।

শব্দজাত দ্ব্যর্থকতা
           বাক্যের কোন একটি শব্দ এমন ভাবে ব্যবহার করা হল যাতে বাক্যের প্রকৃত অর্থ অস্পষ্ট হয় তাকে শব্দজাত দ্ব্যর্থকতা বলে। যেমন.
   পূজা শেষে মেয়েটি বলল, ঠাকুর আমাকে বর দাও।
এখানে,
     ‘বর’ শব্দটি স্বামী/ আর্শীবাদ- উভয় অর্থে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করা যায়।

গঠনজাত দ্ব্যর্থকতা
            বাক্যের গঠনগত কারণে অনেক সময় অর্থের ত্রুটি দেখা যায়। যেমন.
      ‘ঢাকা থেকে কেনা রহিমের কমদামী ঘড়িটি চুরি করবে না’।
এখানে,
    হতে পারে, কমদামী ঘড়ি চুরি করবে না, ঢাকা ব্যতিত অন্যকোথায় থেকে কেনা ঘড়িটি চুরি করবে, ঘড়ি ব্যতিত অন্যকিছু চুরি করা যাবে।

ভাষার বাগর্থিক ত্রুটি হল দ্ব্যর্থকতাঅর্থাৎ, ভাষিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি নানা অস্পষ্টতার জন্ম দেয়।
না বোধক বাক্য
           আমরা অনেক সময় ‘না বোধক- বাক্যে’ দ্ব্যর্থকতা খুঁজে পাই। যেমন.
   ‘ আমি আজ বাড়ির কাজ করিনি’।
এখানে, হতে পারে- তিনি প্রতিদিন কাজ করেন কিন্তু আজ করেননি অথবা আজকে তাঁর কাজ করার কথা ছিল কিন্তু তিনি করতে পারেননি।

পরিমাপক
      অনেক সময় ‘পরিমাপক’- দ্ব্যর্থকতা হয়। যেমন.
 সে একটু অন্যরকম তাঁর সাথে কথা বলতে পার।
সে একটু অন্যরকম তাঁর সাথে কথা বলে লাভ নেই।
তুলনা অর্থে
        ‘তুলনা অর্থে’-  বাগর্থিক ত্রুটি হয়। যেমন.
 শচিন/ সৌরভের মতো ক্রিকেটার হও।
এখানে,
    হতে পারে তাকে শচিন/ সৌরভ হতে হবে অথবা শচিন/ সৌরভের মতো উঁচু মাপের ক্রিকেটার হতে হবে।
ভিন্ন অর্থ প্রয়োগে
            একটি শব্দের বিভিন্ন অর্থ ব্যবহারে বাগর্থিক ত্রুটি হয়। যেমন.
আমি তাঁকে মাতাল অবস্থায় দেখেছি’।
এখানে,
    হতে পারে, আমি মাতাল অবস্থায় ছিলাম/ সে মাতাল অবস্থায় ছিল।
ঋণাত্মক শব্দ ব্যবহার
              অনেক সময় ঋণাত্মক শব্দ ব্যবহারে বাগর্থিক ত্রুটি হয়।যেমন.
‘ তোমার সাথে আমার কথা না বলাই ভালো ছিল’
এখানে,
     তুমি ব্যতীত অন্য কারো সাথে কথা বললে ভালো হত অথবা আমি ব্যতীত অন্য কারো সাথে কথা বললে তোমার ভালো হত।
উচ্চারণগত ত্রুটি
        উচ্চারণ সমস্যার কারণে বাগর্থিক ত্রুটি হয়। যেমন.
তোমার পরা শেষ।(পরিধান অর্থে)
তোমার পড়া থে)(অধ্যয়ন অর্থে)
অ- উপসর্গের জন্য
অ- উপসর্গটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়রূপে বসে। যেমন.
            ইতিবাচক অর্থে- অসাধারণ, অসীম, অপূর্ব।
            নেতিবাচক অর্থে- আকেজ,অকাজ।
বিশেষ্য- বিশেষণ পদগত ত্রুটি
                    অনেক সময় বিশেষ্য- বিশেষণ পদগত ত্রুটিতে বাগর্থিক ত্রুটি হয়। যেমন.
        বেলা চলে গেল।( নারীর নাম- বিশেষ্য)
        বেলা চলে গেল। (সময়- বিশেষষণ)

উপরোক্ত বাগর্থিক ত্রুটিগুলো পরিহার করলে, আমরা প্রমিত ভাষায় আর অর্থপূর্ণ যোগাযোগ করতে পারবে।