বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

প্রাণের শহর ঢাকা

’ঢাকা’ আমার স্বপ্নের নগর। আমার প্রাণের নগর। এ নগর সমাজের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তও উচ্চবিত্ত-সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন ও জীবীকার আশ্রয়স্থল। ঢাকা বাংলাদেশের শুধু রাজধানী নয়, এটি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কামনাবাসনার স্থান।ফ্রান্সের যেমন প্যারিস, অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা, জার্মানির বার্লিন মনুষ্যকাম্য মেগাসিটি তেমনি একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার প্রিয় সিটি ঢাকা। এ নগর আমাকে আবাসস্থান দিয়েছে , উচ্চশিক্ষা অর্জনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে, দিয়েছে সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। প্রেমে যেমন বিরহ আসে, মান-অভিমান হয় তেমনি কখনও কখনও নাগরিক সেবায় বঞ্চিত হয়ে এ নগরের প্রতি অভিমান সৃষ্টি হয়। নগর ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু বেলাশেষে ‘’ঢাকা’’ আমার স্বপ্ন , আমার প্রেরণা।

চারশ বছরের পুরানো শহর ‘ঢাকা’। সেই মুঘল সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বহু আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী ‘ঢাকা’। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, ভারতবর্ষ বিভাজন, পাকিস্তানি শাসন,মহান মুক্তিযুদ্ধও নব্বই এর গণ-আন্দোলন প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামস্থল ছিল ‘ঢাকা’। গত চারশ বছরে এ নগর বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বর্ণও জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে জীবনও জীবিকা দিয়েছে। দিনে দিনে গড়ে উঠেছে এক অসাম্প্রদায়িক মৈত্রী।

বিশ্বের বুকে ‘ঢাকা’ কখনও মসজিদের শহর, রিকশার শহর ,’’মসলিন” কাপড়ের শহর বলে পরিচিত হলেও এখন এটি লাল-সবুজের পতাকাবাহী ‘’ বাংলাদেশের” রাজধানী। প্রায় ১.৫ কোটি লোকের বাস এ নগরে। প্রতিটি নাগরিক সেবা এখানে উপস্থিত। স্বাধীনতা পরবর্তী শিল্পায়ন ও নগরায়ন ফলে, দুর্যোগ কবলিত এ দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যে নগরমূখী হয়েছে তা ‘ঢাকা’।আর তাই মাত্র ৫৬৫ বর্গমাইলের এ শহরে অনেকটা অমানবিক ভাবে এতগুলো মানুষ বাস করে। গড়ে রোজ ২৩০০ মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্নে ঢাকায় আসে। যেহেতু ‘ঢাকা’একটি মেগাসিটি এবং এখানে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় তাই ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্নে ঢাকায় আসা মানুষগুলো ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে গেলেও শহরেই থাকছেন। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপে ঢাকায় প্রতিনিয়ত আবাসন সংকট, দূষিত বায়ু, তীব্র যানজট, পরিবহণ সংকট, গ্যাস সংকট, নিরাপদ খাদ্যের অভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, বিনোদন পার্ক ও খেলার মাঠ সংকট ঢাকাবাসীর নিত্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি সমাজের এক শ্রেণির মানুষ এই নগরীকে নেতিবাচক ভাবে ব্যবহার করেছে। তাঁরা ফুটপাতগুলো অবৈধ ভাবে দখল করে মার্কেট করেছে, কাঁচাবাজার দিয়েছে, ঘরবাড়ি করেছে, বিনোদন পার্কগুলোতে মাদক ব্যবসা ও পতিতালয় করেছে। এরা স্থানীয় কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে কালো টাকা দিয়ে দিনের পর দিন ঢাকা শহরকে দূষিত করেছে।

তীব্র যানজট নগরের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঢাকার মোট রাস্তা রয়েছে ২২০০ কিলোমিটার। এর মাঝে ফুটপাত ৪০০ কিলোমিটার (দখলে)। প্রতিদিন গড়ে ২০০ গাড়ি ঢাকায় নিবন্ধিত যার মাঝে ১০০ ব্যক্তিগত গাড়ি। ব্যক্তিগত গাড়িগুলো মাত্র ৯ শতাংশ যাত্রী পরিবহণ করে আর জায়গা দখল করে রাখে ৩৪ শতাংশ। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যানজটে প্রতি বছর আমাদের ৮৬ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় যার বাজারমূল্য ১৯ হাজার কোটি টাকা।

পূর্বে পরিবেশ নিয়ে ঢাকার অধিকাংশ মানুষ সচেতন ছিলেন না। তাঁরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলতেন। অনেকে সাধারণ মানুষের চলাচলের রাস্তায়ও ময়লা ফেলতেন। এতে স্বাভাবিক হাঁটাচলা ভীষণ ভাবে ব্যহত হতো। ‘ঢাকা’ মহানগর হয়ে উঠেছিলো দূষণের শহর। কিছু খারাপ ব্যবসায়ী ঢাকার তিনটি নদী দখল করে বালু উত্তোলন, নদী ভরাট, ব্জ্র্য নদীতে ফেলে নদীর পরিবেশ পুরোপুরি ভাবে দূষিত করেছে।

ঢাকাবাসী সর্বপ্রথম নাগরিক সেবা পেতে শুরু করে ১৯৯৪ সালে যখন ঢাকাবাসীর ভোটে তাদের প্রথম নগরপিতা হয়ে আসেন মরহুম জনাব মোহাম্মদ হানিফ(১৯৯৪-২০০২)। তাঁর আমলে ঢাকার উন্নয়নে নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ,নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক নির্মাণে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। সুপরিকল্পিত ভাবে ধানমণ্ডি লেক, গুলশান লেক তৈরি করা হয়। তিনি ঢাকা বাসীর জন্য সুপেয় পানির চাহিদা পূরনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমগ্র ঢাকায় বিজলী বাতি লাগানো, বনায়ন করা,নগরের শ্রী বৃদ্ধি করার জন্য ফোয়ারা নির্মাণ , ছাত্রছাত্রীদের জন্য খেলার মাঠ, পাঠাগার, শরীরচর্চা কেন্দ্র তাঁর আমলেই তৈরি করা হয়। নারীদের জন্য ‘’ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ” ‘’মাতৃসনদ” তৈরি করেন।

পরবর্তীতে (২০০২-২০১৪) সাল এই ১২ বছর ঢাকা সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়। যোগ্য নগর পিতার অভাব, প্রশাসনিক দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মাদকের নগরে পরিণত হয় ঢাকা। নানা সামাজিক অপরাধে দিন দিন তাঁর লাবণ্য হারাতে থাকে। নদী, ফুটপাত, পার্ক, মাঠগুলো দখল হয়ে যায়। রমনার বটমূলে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেট হামলায় কলঙ্কিত হয় ‘ঢাকা’। এই সময় বহুবার বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার নাম উঠে আসে।

প্রশাসনিক ভাবে ঢাকাকে ২ ভাগে ভাগ করা হয় ২০১১ সালে। চার বছর পর ২০১৫ সালে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এর জন্য আলাদা আলাদা নগর পিতা পাই। দক্ষিণের মেয়র হিসেবে পাই “ আলহাজ্ব জনাব সাইদ খোকন’’ ও উত্তরের মেয়র হিসেবে পাই ‘’আলহাজ্ব জনাব আনিসুল হক”। তাদের দুজনেরই নির্বাচনী ওয়াদা ছিল “Green Dhaka”। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে রোজ ১৫ ঘণ্টা করে তারা বাসযোগ্য ‘ঢাকা’ গড়তে কাজ করে যাচ্ছেন। গত প্রায় ২ বছরে ঢাকা অনেকটা বাসযোগ্য নগরে পরিণত হয়েছে।

দুজন মেয়রই চেষ্টা করছেন ফুটপাত দখলমুক্ত রাস্তাঘাট করা। গুলিস্তান, মতিঝিল, মোহাম্মদপুর ফুটপাত উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণে নিরাপদ ভাবে চলাচল করার জন্য ৭ টি ফুটওভার ব্রিজ করা হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজগুলোতে দুপাশে পরিবেশ বন্ধু গাছ লাগানো হয়েছে। এতে অনেকটা “GREEN DHAKA’’ নিশ্চিত করা যাচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য সমগ্র ঢাকায় বেশকিছু “পাবলিক টয়লেট” নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো বেশ স্বাস্থ্য সম্মত ও ব্যবহারযোগ্য। ‘’GREEN DHAKA’’ গড়ার জন্য দুই মেয়রই চমৎকার একটি কাজ করেছে তা হল প্রতিটি রাস্তায় “ Waste Bin” বসানো। আজ ঢাকাবাসী অনেকটা সচেতন। তাঁরা আজ যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলে ‘’Waste Bin” ফেলছে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকছে।

আমরা জানি, কোন একটি শহর গড়ে ওঠে কোন নদীকে কেন্দ্র করে। যেমন. “টেমস নদীর” তীরে লন্ডন শহর অবস্থিত তেমনি আমার প্রাণের ‘ঢাকা’ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একসময় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। দুঃসময়ের স্রোতে সে তার লাবণ্য হারিয়ে ফেলেছে। একটা নদী হওয়ার জন্য যে যে গুণগুলো থাকা প্রয়োজন তার একটিও ছিল না বুড়িগঙ্গায়। বিশ্বব্যাংক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন “বুড়িগঙ্গা রক্ষা” প্রজেক্ট গ্রহণ করে যা খুব প্রশংসা লাভ করেছে। এখন বুড়িগঙ্গার পানি অনেকটা দূষণমুক্ত।

ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় বিদ্যুত সাশ্রয়ী “এলইডি লাইট” লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। খেলার মাঠ গুলো আধুনিক করা হচ্ছে। পুরানো বিভিন্ন পাঠাগার ও শরীরচর্চাকেন্দ্র সংস্কার করা হচ্ছে। এতে ছাত্রছাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে।

বর্তমানে ‘’যানজট’’ ঢাকার প্রধান সমস্যা। সিটি কর্পোরেশনগুলো ২০ বছরের অধিক ফিটনেস বিহীন গণপরিবহণ বন্ধ করেছে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে যানজট দূর করা যাচ্ছে না। তাই সিটি কর্পোরেশনগুলো রাস্তার আঁকার বাড়ানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি পরিবহণ, সড়ক- যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে গণপরিবহণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

নাগরিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য উন্নত ড্রেনেজ সেবা, মশা নিধন, কুকুর দমন, এক স্থানে কুরবানির পশু জবাই করা, নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সহ বিভিন্ন প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে।

পরিশেষে, আমার প্রাণের নগর “ ঢাকা”। আমার মত কোটি সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবীকার ব্যবস্থা করেছে ‘ঢাকা’ শহর। আমরাই এ শহরের প্রাণ। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে এক স্বপ্নের ‘ঢাকা’ নগরী করতে পারবো। মেয়র, জেলা প্রশাসন একা সবকিছু করতে পারবে না। আমরা যদি আমাদের নাগরিক দায়িত্ব গুলো পালন করি তাহলেই উন্নত ‘ঢাকা’ গড়া সম্ভব। ফ্রান্সের প্যারিসকে দেখে কথাসাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘’পথে প্রবাসে’’ ভ্রমণকাহিনিতে বলেছিলেন “ অর্ধেক নগরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’’ তেমনি স্বপ্নের নগর ঢাকাকে নিয়ে আমি বলতে পারি “অর্ধেক নগরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’’।

------------ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন