নদীনির্ভর বাংলা কথান্যাসের
ধারায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) লেখা আঞ্চলিক উপন্যাস ‘তিতাস
একটি নদীর নাম’(১৯৫৬) অর্জন করেছে বিশিষ্টতা। ‘তিতাস একটি
নদীর নাম’ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি নির্মাণ করেছেন জল ও জীবনের
ঐকতান আর এই ঐকতানে অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিম্নবর্গের প্রবাহমানতার শাশ্বত প্রতিনিধি হিসেবে
‘বাসন্তী’ চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে নদীকেন্দ্রিক
আরো আঞ্চলিক উপন্যাসগুলো হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
‘পদ্মা নদীর মাঝি’(১৯৩৬), হুমায়ূন কবিরের ‘ নদী ও নারি’(১৯৩৬),
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ ইছামতি’(১৯৫০), সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’(১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য।
তিতাস- তীরের গোকর্ণ গ্রামের যে পাড়ায় অদ্বৈতের বেড়ে
ওঠা, ভদ্রভাষায় তার নাম ‘মালোপাড়া’
হলেও সেটি ভদ্রসমাজে ‘গাবরদের পাড়া’ বলে বহুল পরিচিত। এই নিয়ে সমালোচক বলেন,
“শ্রমজীবী আন্তেবাসী জেলে সম্প্রদায়ের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই লোকেরা এই নাম সৃষ্টি করেছেন। আর এই প্রাকৃত জীবন ও কৌম সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে লেখেন তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি’’।^১
তিতাস নদী থেকে মাছ ধরে
জীবিকা নির্বাহ করা একদল জেলে সম্প্রদায়ের(মালো সমাজ) জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন
ঔপন্যাসিক। মালোদের জীবনের এক সমগ্রিক চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে।
প্রতিটি মালো নর-নারীর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁদের গোষ্ঠী জীবনের নিজস্ব সংস্কৃতি ও
ঐতিহ্য এবং তিতাসের উপর নির্ভরশীল মালোদের জীবন ও জীবিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিচয় ধরা
পড়েছে এই উপন্যাসে।
‘ তিতাস একটি নদীর নাম’
উপন্যাসটি নিবিড় পাঠ করলে আমরা এর মাঝে একটা বিষণ্ণতার ছোঁয়া তথা একটা ট্র্যাজিক
সুর ফুটে উঠতে দেখি। যার মূলে রয়েছে জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির চিরকালীন
দ্বন্দ্ব। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে যে চরিত্রটি জীবনযুদ্ধে, স্বয়গোষ্ঠীর ঐতিহ্য-
সংস্কৃতি রক্ষায় একাই লড়াই করেছে সে বাসন্তী।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের নায়িকা বাসন্তী যার শইশব কৈশোর গড়ে
উঠেছে কিশোর আর সুবলের সাথে। যদিও বাসন্তীর মনের দুর্বলতা
কিছুটা কিশোরের প্রতি ছিল। মৎস্য শিকারের উদ্দেশ্যে
রওনা হবার আগেই বাসন্তীর সাথে তাঁর বিবাহ স্মির হয়েছিল; কিন্তু বাসন্তীকে বিবাহ করতে চায়নি কিশোর। কিশোরের মতে,
“বিবাহ তাকেই করা যায়, যার সাথে কোনদিন কোন পরিচয় থাকে না……নতুন করে মন তাঁকে চিনবে,
জানবে, তাতেই মনের সুখ’’।
-
তাই কিশোরকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি বাসন্তীর।
কিশোরের সাথে বাসন্তীর
বিবাহ স্মির হলেও সুবল বাসন্তীকে মনে মনে ভালোবাসতো তাই যে মুহূর্তে সে কিশোরের
কাছে জানতে পারে কিশোর বাসন্তীকে বিবাহ করতে চায় না সেই মুহূর্তে সুবলের মনে মনে
আশার সঞ্চার হয়।
“সকল কথা শুনিয়া সুবল
আনন্দে লাফাইয়া উঠিয়া বলে,
‘ দাদা, তা হইলে বাসন্তীরে তুমি এখানেই পাইয়া
গেলা। অখন দেশের বাসন্তীরে কার হাতে তুইল্যা দিবা কও’
‘ তোর হাতে দিলাম’
সুবলের মনে একটা আশার রেশ
গুনগুন করিয়া উঠে”।
বিবাহের পর বাসন্তী আর সুবলের
দীর্ঘদিন আর ঘর বাঁধা হয়নি। নৌকা চাপা পড়ে নৃশংস ভাবে প্রাণ হারায় সুবল আর বিধবা
হয় বাসন্তী। আর এই তিক্ত জীবন অভিজ্ঞতা বাসন্তীর পুরুষ সমাজের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট
করে দিয়েছে।
“পুরুষ মানুষ দিয়া কি হইব?
তাঁরা বৃষ্টির পানির ফোঁটা, ঝরলেই শেষ। তাঁরা জোয়ারের জল, তিলেক মাত্র সুখ দিয়া
নদীর বুক শুইষ্যা নেয়’’।
একজন বিধবা নিঃসঙ্গ নারীর
জীবনে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হল তাঁর সন্তান। নিজের সন্তান না হওয়ার পরেও অনন্তের
মাঝে সুপ্ত জননী সত্তা খুঁজে পেয়েছিল বাসন্তী।
“ মাসি ডাকে আকৃষ্ট হইয়া
সুবলার বউ চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, তারপর সে উদ্দাম হইয়া বলিয়া উঠিল, অনন্ত? আমার
অনন্ত!’’
আর্থিক ও সামাজিক
নিরাপত্তার অভাবে অনন্তের সাথে বাসন্তীর ‘ অস্তিত্ব সংকট’ দেখা যায়-
“ তুইও কি আমার পর হইয়া
গেল অনন্ত?’’
মালোদের নিজস্ব কালচার
বলতে ছিল ভাটিয়ালি গান, কীর্তন গান সহ নানা লোক সংগীত। কিন্তু কালের বহমানে বাহিরে
থেকে আসা শাহরিক যাত্রাদল এর স্থান দখল
করে। মালোদের নিজের সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য বাসন্তী ও মোহনের সংগ্রাম ব্যর্থতায়
পরিণত হয়।
“মাত্র দুটি নরনারী গেল
না। তাঁরা সুবলার বউ আর মোহন। অপমানে সুবলার বউ বিছানায় পড়িয়া রহিল আর বড় দুঃখে
মোহনের দুই চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল’’।
সার্বিক ভাবে আমরা বলতে পারি, প্রত্যাশা ও
প্রাপ্তির দ্বন্দ্বে বাসন্তী চরিত্রটির ট্র্যাজিক পরাজয় হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়